আমি নন্দিনী।নামটা ঠাকুমা দিয়ে ছিলেন। এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ে।বাবা রমেশ চক্রবর্তী।এটাই আমার পরিচয়।বাবা ব্যাংকের ক্যান্টিন দেখাশুনা করেন।সামান্য কিছু মাইনে পত্র পান।
মা প্রায় নিরক্ষর বললেই চলে।তবে মা খুব সাহসী এবং দায়িত্বশীল।বাবা সপ্তাহে একদিন রবিবার বাড়িতে থাকেন।বাড়ির অসম্পন্ন কাজকে সম্পন্ন করে পরদিনই যথা সময়ে কর্ম স্থানে যোগ দেন।
মায়ের সংসারে গরু ছাগল নিয়ে সারা দিন কেটে যায়।বছর দুয়েক আগে ঠাকুমা মারা যায়। মা একা হাতে সংসার সামলায়।আমরা তিন ভাই বোন।আমি সবার বড়ো।তার পর বোন ।আর সবার ছোট ভাই।ছোটো বেলা থেকে আমি পড়াশুনায় ভালো।প্রত্যেক ক্লাসে ফাষ্ট হয়ে আসছি।বোন মোটামুটি ভাবে মাধ্যমিক পাস করেছে।ভাই এর পড়াশুনা বেশি দূর এগোয়নি।তার পড়াশুনা ভালোই লাগতোনা না।
আমি পড়া শুনার পাশাপাশি আবৃত্তি নাটক মঞ্চস্থ করে থাকি। স্কুলের শিক্ষকরা আমাকে যথেষ্ট ভালো বাসে।আমার পড়াশুনার খরচ বহন করতে বাবার পক্ষে অনেকটা অসুবিধে হতো।তখন স্কুলের শিক্ষকরা এগিয়ে এসে কেউ বইপত্র কেউ বা খাতা কলম দিয়ে সাহায্য করেছেন।আমি আজ সেই সব শিক্ষকদের স্মরণ করি। তাঁরা যদি সহযোগিতার হাত না বাড়াতেন আমি হয়তো আজ এ জায়গায় আস্তে পারতাম না।বাবার এক পরিচিতির মাধ্যমে আমার পরের জেলায় একটি কলেজে ভর্তি হই।সেখানে থাকা খাওয়া হোস্টেল খরচ প্রায় অর্ধেক পয়সায় একটা সুব্যবস্থা করে দেয়।
এখান থেকে আমি বি কম পাস করি।এর পর এম কম পাস করে এক দু মাসের মধ্যে একটা সরকারী স্কুলে চাকরি পেলাম।এবার ভাবলাম বিয়েটা করেই ফেলি।আমি ব্রাহ্মণ হয়েও এক মুসলিম ছেলেকে ভালো বাসি।ওর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়।ও খুব ভালো ছেলে।ও একটা ভালো প্রাইভেট জব করে। ওকে আমার খুব ভালো লাগে।ও কোনো নেশা করে না। দেখতে সুন্দর এবং স্মার্ট। বোনের বিয়ে আগে হয়ে গেছে।বাবা অনেকটা কষ্ট করে বোনের বিয়ে দিয়েছিল।আজ বোন বিধবা হয়ে বাবার বাড়িতে থাকে।একটা এক বছরের মেয়ে রেখে জামাই মারা যায়। জামাই লোরির ড্রাইভার ছিল। মদের বোতল ছিল তার সঙ্গী।সারাক্ষণ নেশায় ডুবে থাকতো।একদিন বউ আর কোলের একটা ছোটো মেয়েকে রেখে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। তারপর থেকে আমি নেশা গ্রস্ত মানুষকে মোটেই দেখতে পারি না। বেশির ভাগ হিন্দু পরিবারের ছেলেরা মদ্যপান করে। মুসলিম ছেলেরা মদ্যপান করে না বললেই চলে। তাদের ধর্মে মদ্যপান নিষিদ্ধ। তারা এক ঈশ্বরের উপাসনা করে।তারা দিনে পাঁচ বার ঈশ্বরের স্মরণাপন্ন হয়। কোনো ঢাক ঢোল না বাজিয়ে মসজিদে বা ঘরে ঈশ্বরের কাছে মাথা নত করে সেজদা করে । এবং আল্লাহর কাছে সারাদিনের ভুল ভ্রান্তির ক্ষমা চেয়ে নেয়। মুসলিমদের এই ধ্যান ধারনা আমার খুব ভালো লাগলো।
আমি ফায়েজ কে জীবন সঙ্গীনি হিসাবে বেছে নিলাম। ফায়েজের বাড়ির লোকেরা আমাকে কোনো মতেই মেনে নিলনা।ওর মা বছর চার পাঁচেক আগে মারা যায়।বাবা পোর্ট ট্রাস্টে চাকরি করেন।তিনি হিন্দু মেয়েকে বাড়ির বউ হিসাবে মেনে নিতে পারবে না। ফায়েজের তিন ভাই ফায়েজ সবার ছোটো। ওর বাবা একদিন ফায়েজকে ডেকে বলে। তুমি যা করেছ বড়ো অন্যায় করেছ। মেয়েটিকে তোমাকে ছাড়তে হবে।না হলে আমার এই বাড়ি ছাড়তে হবে।আমি কোনো ঝামেলার মধ্যে থাকতে চাই না।আমাদের চাল চলনের সাথে ওরা খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না।আমি আর এত কিছু বিতর্কে যাচ্ছি না। আশা করি তুমি আমার কথাটা রাখবে।
ফায়েজ ঠিক করে ফেলল সে আমাকে নিয়ে বাড়ি ভাড়া করে থাকবে।আমি তা হতে দেই নি।আমি ওকে নিয়ে আমার শ্বশুর মশাই এর কাছে এলাম উনি কিছুটা ক্ষান্ত হয়ে অবাক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এগিয়ে গিয়ে একটা প্রণাম করলাম। কিছু বললেন না।মা তুমি এখানে এসে বসো। তোমার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে। তোমরা কী জানো যেটা করেছ সেটা সম্পূর্ণ ভুল করছো। মা আমাকে ক্ষমা করো। তোমাদের এই সম্পর্ক আমি মেনে নিতে পারছি না। তাছাড়া তুমিতো শ্বশুর বাড়ি পাবে।আমার ছেলে কি পাবে। আমার ছেলে শ্বশুর শাশুড়ির থেকে বঞ্চিত হবে।সে শ্বশুর বাড়ি কোনো দিন যেতে পারবেনা। সময়ে শ্বশুর বাড়ির লোক জনদের অনেক প্রয়োজন হয়। তোমার বাবা মা জানে তুমি যে মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করেছ। হ্যা,আমার বাবা মাকে আমি সব কিছু খুলে বলেছি।তারা আমার ভালো মন্দের উপর ছেড়ে দিয়েছে। তাছাড়া ফায়েজ কে আমার বাড়ির সবাই ভালো বাসে। বাবা আমি ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। এখন ও আমার স্বামী ওর কোনো ক্ষতি হোক আমি কোনো দিন চাই না। আপনি আমাকে ঠাঁই দেন আর নাই দেন আমি ওকে বিয়ে করেছি। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনার ছেলেকে কেড়ে নিতে চাইনা।ও যথেষ্ট ভালো ছেলে। বাবা আমাদের আশীর্বাদ করুন যাতে আমি আপনাদের সবাইকে খুশি রাখতে পারি। উনি আমার বাবা মাকে ডেকে পাঠালেন। আমার বাবা মা চট জলদি এখানে এসে উপস্থিত হলেন। দাদা আমরা আপনার ছেলে ফায়েজ কে জামাই হিসাবে মেনে নিয়েছি। আমরা দুটো পরিবার চাই যেন ওরা সুখি হোক। ধর্ম ধর্মের জায়গায় থাক।আমরা মানুষ এটা সবচেয়ে বড় ধর্ম।
যারা ধর্ম নিয়ে বড়াই করে তারা মানুষের মধ্যে পড়ে না।তারা তাদের নিজেদের স্বার্থে মানুষ খুন করে। এই পৃথিবীতে এখনো অনেক ভালো মানুষ আছে।তাদের জন্য পৃথিবীটা এখনও ধ্বংস হয়নি। যত নেতা মন্ত্রী তৈরি করবেন ততই ধ্বংস লীলা দেখবেন।সারা পৃথিবীতে নেতা মন্ত্রীদের যে উত্থান দেখবেন ধ্বংস অনিবার্য। সাধারণ মানুষেরা তাদের লেজে হাত বুলায়।যদি তাদের আত্বসাতের টাকার কিছু অংশ ভাগ পায়। আমরা সাধারণ মানুষ কিভাবে ভালো থাকবো আমাদের ভাবতে হবে। আর আমাদের প্রজন্মের কথা ভাবতে হবে।মনে রাখবেন নেতা মন্ত্রীদের তাদের একটাই উদ্দেশ্য দেশের সম্পদ লুট করো। আর যারা বাধা দেবে তাদের দেহ লোপাট করে দাও। যারা এ ধরনের কাজ করে তাদের উৎখাত করে ফেলতে হবে। সব সময় আমাদের প্রজন্মের কথা ভাববেন। তাদের জন্য আমরা কি রেখে গেলাম।
যাক, দাদা আপনি ছেলের বাবা। আমার মেয়ে ঠিক করেছে কী ভুল করেছে এখন ভাবার আর কিছু নেই। আমার মেয়ে যথেষ্ট লক্ষ্মী। তাকে একটু জায়গা দেন।আর আমি ওদের সম্পর্ক টাকে মন প্রাণ দিয়ে মেনে নিয়েছি। আমরা স্বামী স্ত্রী যতকাল বেঁচে থাকব আমার মেয়ে জামাই আমার বাড়ীতে যাতায়াত করবে। দাদা আমি হাত জোড় করে অনুরোধ করছি, ওদের বাড়ির বাইরে এভাবে বের করে দিবেন না। শ্বশুর মশাই ছুটে এসে বাবার হাত দুটো ধরে ফেললেন। বিয়াই মশাই আপনার কথাগুলো মনযোগ সহকারে শুনছিলাম।আপনার মত মানুষই আমার বিয়াই হওয়ার যোগ্য।আজ আপনার মেয়েকে আমি আমার পুত্রবধূ হিসাবে মেনে নিলাম। বড়ো বৌমা, ছোটো বৌমাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এসো। ফায়েজের রুমটা দেখিয়ে দাও। দাদা আজ তাহলে আসি। শ্বশুর মশাই বাবা মাকে ছাড়লেন না।কাজী ডেকে ধুমধাম করে আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। আমি আজ আমার শ্বশুর বাড়ি পেয়ে খুব সুখী।
আমার শ্বশুর,শ্বশুর বাড়ির লোক জন আমাকে খুব ভালোবাসে। আর আমার স্বামীকে পেয়ে আমি খুব সুখী।আমার একটি ছেলে রাজ তাকে নিয়ে আমার এখন গর্ব।আমার শ্বশুর মশাই ভীষন ভালো মানুষ। তিনি পূজনীয় সব বৌমারা তাঁকে পূজা করেন। বৌমাদের যথেষ্ট ভালো বসেন। আমাকে আজ একটা কথা বলতে হয়।বিধর্মী ছেলেকে বিয়ে করা নিয়ে অনেকের মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাঁড়ায়। এই পৃথিবীতে মানুষ এসেছে। ধর্ম তখন ও আসে নি। মানুষই ধর্ম সৃষ্টি করেছে। তাদের সুবিধার্থে ছোটো বড়ো ধর্মে রূপান্তর তারা নিয়ে এসেছে।আমার ধর্মটা বড়ো।আর অন্যের ধর্মটা ছোটো।এটা মানুষের গড়া মানুষ সবার উপরে এটাই সত্য।একটা ভালো মানুষ এটাই যথেষ্ট। তার আগে পেছনে স্ট্যাম্প দেখার কোনো দরকার নেই। মানূষকে বেশি বেশি করে ভালো বাসতে শিখুন।আপনারা সবাই ভালো থাকবেন। সুস্থ্য থাকবেন। ধন্যবাদ।